একদা সব সুরাসুরের খেয়াল হল দাদা (ekoda sob surasurer kheyal holo dada)

একদা সব সুরাসুরের খেয়াল হল দাদা।
সমুদ্রেরে ঘেঁটে ঘুঁটে করতে হবে দধিকাদা॥
দেখেছ তো গয়লানিরা যে-ভাবে দই মথে।
(তেমনি) সাগরকে সব ঘুঁটেছিলেন মন্দার পর্বতে॥
(অর্থাৎ) মন্দার গিরি হয়েছিল দই ঘুঁটবার কাঠি॥
আর কূর্ম হলেন সমুদ্ররূপ দই রাখবার বাটি॥
কাঠি এলো, বাটি এলো, দড়া কোথায় পান।
(সবে) বাসুকীর শ্রী-লেজুড় ধ’রে মারেন হেঁচ্‌কা টান॥
বাসুকী কয় ল্যাজ ছাড়ো বাপ গ্যাজ উঠল মুখে।
বাসুকীকে করল দড়া দেবতারা সব রুখে॥
ল্যাজ ধরল দেবতা, অসুর দানব ধরে মুড়ো।
সাগর বলে আস্তে বাবা একি প্রলয় হুড়ো॥
যা আছে মোর বের করছি 
 ঘাঁটিস্‌নে আর পেট॥
উচ্চৈঃশ্রবা, চন্দ্র, লক্ষ্মী 
 সব দিচ্ছি ভেট॥
(ক্রমে) অমৃত যেই উঠল অমনি লাগলো গুঁতোগুঁতি।
দৈত্যেরা সব কোপ্‌নি আঁটে দেবতা কষেন ধুতি॥
মাঝে থেকে শ্রীবিষ্ণু মোহিনী রূপ ধ’রে।
ছোঁ মেরে সেই সুধার ভাণ্ড নিয়ে পড়লেন স’রে॥
অমৃত খান দেবতারা সব, অসুর মাটি চাটে।
(যেমন) দোহন শেষে দুগ্ধ খোঁজে বাছুর শুকনো বাঁটে॥
(ক্রমে) ঘটর ঘটর ঘোঁটার ঠেলায় উঠলো হলাহল।
ত্রাহি ত্রাহি বলে ত্রিলোক, করে কোলাহল॥
বিষের জ্বালায় সৃষ্টি বুঝি পটল তোলে ওই।
সিদ্ধিখোর শ্রীপিশাচপতি কয় ডেকে মাভৈঃ॥
ছুটে এসে পাগ্‌লা ভাঙোড় এক সুমুদ্দুর বিষ।
ঢক ঢকিয়ে ফেললে গিলে গা করে নিস্‌পিস্॥
বলদে যে বেড়ায় চ’ড়ে ছাই পাঁশ গায়ে মাখে।
তাকে ছাড়া চতুর দেবতা বিষ দেবে বল কাকে॥
ফুলের মধ্যে ধুতরো নিলেন মশান যাহার ঘর।
(পোড়া) কপালে তার আগুন জ্বলে 
 জয় ন্যাংটেশ্বর॥

  • ভাবসন্ধান:  ভাবসন্ধান: মন্মথ রায়ের রচিত 'সতী ' নাটকে সনাতন হিন্দু ধর্মে বর্ণিত সমুদ্রমন্থনের কাহিনিকে রঙ্গাত্মক অভিব্যক্তিতে উপস্থাপন করা হয়েছে। কাহিনির শেষে বিশেষভাবে মহাদেবের মহিমাকে তুলে ধরা হয়েছে।
    পুরাণে যেমন এক ঋষির অনুরোধে অন্য ঋষি পৌরাণিক কাহিনি বলেন, তেমনটি এই নাটকের বরণনাকারী 'কথক' যেন গল্পের আসরে বসে পৌরাণিক কাহিনিই নতুনভাবে শ্রোতাদের সামানে উপস্থাপন করেছেন। এই গানের কাহিনিটি পরিবেশিত হয়েছে ঘরোয়া আসরের আটপৌরে ভাষারীতিতে। এই গানে পরিবেশিত গল্পটি হলো-

    কোনো একদিন দেবতা আর অসুররা সিদ্ধান্ত নিলেন যে- তাঁরা সমুদ্র ঘেঁটে ঘুঁটে দধির মতো কর্দমাক্ত করবেন। কথকের এই বক্তব্য থেকে মনে হয় দেবাসুরদের অমৃত লাভের ইচ্ছাই ছিল না। যেন সমুদ্র ঘাঁটার জন্যই এই উদ্যোগ। ঘটনাক্রমে তাঁরা পেয়েছিলেন সমুদ্রের গর্ভজাত নানা মহার্ঘ্য সামগ্রী। 

    সমুদ্রমন্থনের বিবরণটি এই গানে  উঠে এসেছে একটি সরস উপমা-মাধ্যুর্যে। গয়ালানিরা (মিষ্টান্ন তৈরীকারিণীরা) যেমন করে দই মথিত করে, তেমনি দেবতা আর অসুররা মন্দর পর্বত তুলে এনে তাকে মন্থনদণ্ড করে সমুদ্ মন্থন শুরু করেছিলেন। একাজে কূর্মকে (কাছিম) তাঁরা দই রাখাবার বাটির মতো ব্যবহার করেছিলেন। কাঠি আর বাটি যোগাড় হওয়ার পর তাঁরা দেখলেন- মন্দর পর্বত বেঁধে সমুদ্রমন্থন করার জন্য দড়ি যোগাড় হয় নি। তখন তাঁরা ঘুমন্ত বাসুকির (অনন্তনাগ)  শ্রী-লেজুড় ধ’রে হেঁচ্‌কা টানা শুরু করলেন। টানের চোটে অনন্তনাগের মুখ দিয়ে গ্যাজলা উঠ শুরু হলে- তিনি পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সুরাসুরের কাছে কাতর অনুরোধ করলেন। তারপরেও এঁরা অনন্তনাগকে দড়ি বানিয়ে মন্দর পর্বতকে বাঁধলেন। এবার দেবতারা বাসুকির লেজ ধরে আর অসুররা  তাঁর মাথা ধরে সমুদ্র মন্থন শুরু করলেন। এই মন্থনে সাগর অতীষ্ট হয়ে বলেনো- ঠিক আছে বাপুরা এবার তোরা থাম। আমার পেটের ভিতরে যা আছে সব কিছু বের করে দিচ্ছি। এরপর সাগরের পেট থেকে উঠে এলেন উগ্রশ্রবাঃ নামক ঘোড়া,  চন্দ্র লক্ষ্মীদেবী। এরপর উঠে এলেন অমৃত ( অমৃতের পাত্র হাতে ধন্বন্তরি উঠেছিল)। অবশ্য এই গানে ধন্বন্তরীর নাম নেই। যেন একাই অমৃত উঠে এসেছিল।

    অমৃত দেখে দেবাসুররা কে আগে তার সাধ নেবেন তার জন্য গুঁতোগুঁতি শুরু করলেন। অসুররা তৈরি হলেন কোপ্‌নি এঁটে, আর দেবতারা কষে বাধলেন ধুতি। এই হট্গোলের ভিতরে বিষ্ণু মোহিনী রূপ (অপরূপা নারী) ধরে ছোঁ মেরে অমৃতের ভাণ্ড নিয়ে পালালেন। এরপর দেবতারা চেটেপুটে সব অমৃত খেয়ে ফেললে, দোহন শেষে বাছুর যেমন গাভীর বাঁট বৃথাই চাটে, তেমনি অসুররা  অমৃতশূন্য মাটি চাটতে থাকেন। এবার অসুররা আবার সমুদ্র মন্থন শুরু করলে, হলাহল নামক তীব্র বিষ উঠলো। এই বিষের প্রভাবে ত্রিলোকে ত্রাহি ত্রাহি (বাঁচও বাঁচাও) কোলাহল শুরু হলো। এমন অবস্থায় বিষের জ্বালায় সবার পটল তোলার অবস্থা সৃষ্টি হলো। এমন সময় সিদ্ধখোর শ্রীপিচাশপতি (মহাদেব) সবাইকে ডেকে বললেন মাভৈঃ (ভয় নাই)। তারপর ছুটে এসে পাগলা ভাঙোর (ভাং বা সিদ্ধিখোর অর্থে মহাদেব), সমুদ্রের সকল জল ঢক ঢক করে খেয়ে ফেললেন।

    এই গানের শেষে রয়েছে রঙ্গব্যঙ্গে উপস্থাপিত মহাদেবের মহিমা। কথকের ভাষায়- এই দেবতা গায়ে ছাই পাঁশ মেখে বলদের পিঠ চড়ে ঘুরে বেড়ান। তিনি ছাড়া এ বিষ কে গ্রহণ করার কেউ ছিল না। ফুলের মধ্যে বিষাক্ত ধুতুরা যিনি গ্রহণ করেন।  মশানই (শ্মশান, প্রেতভূমি; বধ্যভূমি) যাঁর ঘর, যাঁর পোড়া কপালে জ্বলে আগুন (তৃতীয় নয়নের আগুন)। কথক সেই ন্যাংটেশ্বরের জয়ধ্বনি দিয়েছেন। উল্লেখ্য মহাদেবের পরনে বাঘছাল থাকে সামান্য আবরণ হিসেবে. তাই তাঁকে রঙ্গকরে বলা হয়েছে ন্যাংটাদের ঈশ্বর।

     
  • রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ এপ্রিল (বুধবার, ১৫ বৈশাখ ১৩৪৪), মন্মথ রায়ের রচিত 'সতী '  নাটক  নাট্যনিকেতন নামক রঙ্গালয়ে মঞ্চস্থ হয়। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৩৭ বৎসর ১১ মাস।
     
  • মঞ্চ নাটক: সতী (নাটক)। রচয়িতা মন্মথ রায় । [নাট্যনিকেতন। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ এপ্রিল (বুধবার, ১৫ বৈশাখ ১৩৪৪)। চরিত্র: কথক। শিল্পী: রাধাচরণ ভট্টাচার্য]
     
  • গ্রন্থ:
    • সতী। নাটক। প্রথম অঙ্ক। প্রথম দৃশ্য। সখীদের গান। মন্মথ রায়  নাট্য গ্রন্থাবলী। ষষ্ঠ খণ্ড। মনমথন প্রকাশন। ১৩৬৫ বঙ্গাব্দ (১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দ)। পৃষ্ঠা: ২১৯
    • নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ [নজরুল ইন্সটিটিউট, ফেব্রুয়ারি ২০১১। গান সংখ্যা ১১৬৩। পৃষ্ঠা: ৩৫৪।
  • পর্যায়:
    • বিষয়াঙ্গ: ধর্মসঙ্গীত। সনাতন হিন্দধর্ম। শাক্ত। মহাদেবের বন্দনা (রঙ্গার্থে)

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।