শাওন-রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে (shaon -rate jodi shorone ashe more)

শাওন-রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে
বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে॥
ভুলিও স্মৃতি মম, নিশীথ-স্বপন সম
আঁচলের গাঁথা মালা ফেলিও পথ 'পরে॥
ঝুরিবে পুবালি বায় গহন দূর-বনে,
রহিবে চাহি' তুমি একেলা বাতায়নে।
বিরহী কুহু-কেকা গাহিবে নীপ-শাখে
যমুনা-নদীপারে শুনিবে কে যেন ডাকে।
বিজলি দীপ-শিখা খুঁজিবে তোমায় প্রিয়া
দু'হাতে ঢেকো আঁখি যদি গো জলে ভরে॥

  • কোনো এক বিরহী'র স্বকল্পিত দুঃখ-বিলাসের ভাবনা উঠে এসেছে এই গানে। তাই হয়তো এই গানের পংক্তিগুলোই অসংলগ্ন ভাবনায় গাঁথা। যেন খণ্ড খণ্ড অস্থির অসম্পূর্ণ ভাবনা। ভাবের বিচারে এই গানের স্থায়ী অসম্পূর্ণ। স্থায়ীতে একটি ভাবনা 'যদি' দিয়ে শুরু হয়, কিন্তু শেষ হয় না। এই 'যদি'র সমাপ্তি পাওয়া যায় অন্তরাতে। গানটীর স্থায়ী ও অন্তরা মিলে যে ভাবটুকু পাওয়া যায়, তাহলো-

'যদি কোনো এক বরষণ মুখর শ্রাবণ রাতে, তাঁর প্রেমিকার স্মৃতিপটে তাঁর স্মৃতিতে ভেসে ওঠে, যদি  বাইরের ঝড়ো বরিষণের সাথে তার চোখে  বেদনার অশ্রু ঝরে পড়ে, 'তাহলে সে যেন তা গভীর রাতে দেখা স্বপ্নের মতো সকল স্মৃতি ভুলে যায়। যদি তাকে নিয়ে সেই প্রেয়সী কোনো স্মৃতির মালা গাঁথে, তা যেন ভাবনার পথেই ফেলে দেয়।'

 যেন- যা ঘটতে পারে, সেই কষ্ট-কল্পনায় এই গান হয়ে উঠেছে দুঃখ-বিলাসে আত্ননিপীড়ন। তাই কবি কল্পনায় দেখতে পান বিরহিনী প্রেমিকার এক বেদনাবিধূর এবং অসহায়া দশা। বিরহী  অনুভব করেন- যখন শ্রাবণের পূবালি বাতাসে দূরের গভীর অরণ্যে বিরহের বেদনা অশ্রু হয়ে ঝরে পড়বে, তখন তার বিরহিণী যেন একাকী জানালার পাশে বসে শুধু দেখবে তার ফেলে আসা দূর অতীতের মধুরপ্রেম, অনুভব করবে কাছে না পাওয়ার বেদনা। যখন বিরহী কোকিল, ময়ূর কদম ডালে বসে বিরহের গান গাইবে, তখন তার ভিতর দিয়ে যমুনা-নদী পারে হারানো প্রেমিকা যেন তার প্রেমিকের ডাক শুনতে পাবে। কবি কল্পনায় কদম্ব শাখায় কুহু-কেকার ধ্বনির ভিতর দিয়ে, যমুনা-তীরে বিরহী কৃষ্ণের অনুভবের ছায়াপাত ঘটে, সেখান যমুনা নদী হয়ে উঠেছে বিরহিনী রাধার বিরহ-বিহারের লীলাভূমি। যেখানে আকাশের বিদ্যুতের আলোয় বিরহীকৃ্ষ্ণ বিরহিনী রাধাকে খুঁজে ফিরছে। সব শেষে কবি এই দুঃখ-বিলাসের সমাধানে আসতে চেয়েছেন। গানের ভাষায় কবি উপস্থাপন করেছেন- এসব স্মৃতিকাতরতা ভরা স্বপ্নে যদি তার প্রেমিকার চোখ জলে ভরেও যায়, তাহলে সে যেন দুহাতে তাঁর বেদনাকে ঢেকে ব্যথাকে সম্বরণ করে।

  • রচনাকাল ও প্রেক্ষাপট: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ (চৈত্র ১৩৪৬-বৈশাখ ১৩৪৭) মাসে এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানি গানটির প্রথম রেকর্ড প্রকাশ করে। জগন্ময় মিত্র এ প্রসঙ্গে তিনি তাঁর 'শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে' গ্রন্থে [পৃষ্ঠা: ৩৩] এই গানটির রেকর্ড করার তারিখ উল্লেখ করেছেন '১৮-৫-৩৯'।  এই সময় নজরুল ইসলামের বয়স ছিল ৪০ বৎসর ১ মাস। কিন্তু গানটি রচিত হয়েছিল ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকে। অর্থাৎ গানটি নজরুল রচনা করেছিলেন তাঁর ৩৯ বৎসর অতিক্রান্ত বয়সের শেষের দিকে।

    উল্লেখ্য, ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের শেষের কাজী নজরুল ইসলাম-এর সাথে জগন্ময় মিত্রের পরিচয় প্রসঙ্গে তিনি তাঁর 'শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে' গ্রন্থে [প্রতিভাস, কলকাতা। পৃষ্ঠা: ৩২-৩৪] আলোচনা করেছেন। এই গ্রন্থ মতে- এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানি রেকর্ড কর্মকর্তা হেমচন্দ্র সোম, নজরুলের সাথে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। প্রথম পরিচয় প্রসঙ্গে জগন্ময় মিত্র লিখেছেন-

'...কাজীদা জিজ্ঞাসা করলেন, 'কিছু ঠিক করেছিস কী গাইবি? একটু ইতস্তত করে বললাম, "আমি দু-একটা গান লিখে সুর করেছি।" কাজীদা বললেন, আচ্ছা শোনা"

জগন্ময় তাঁর লেখা সুরে গানটি শোনালেন। গানটি হলো- 'যদি বাসনা মনে দিবে দহন জ্বালা/তবে মনের কোণে কেন বাসিলে ভালো'। নজরুল গানটি শোনার পর সুরের প্রশংসা করলেও বাণীর প্রশংসা করতে পারেন নি। তারপর নজরুল গানটি কয়েকবার জগন্ময়ের কাছে শুনে, সেই সুরের উপর 'শাওন রাতে স্মরণে আসে মোরে' গানটি রচনা করেছিলেন। এই গানটির সুর সম্পর্কে জগন্ময় লিখেছেন- 'আমার গুরু ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় একবার একটা গান আমাদের গেয়ে শুনিয়েছিলেন। সেটি হলো- 'আজি ঝরলা' । রাগের নাম বলেছিলেন, যতদূর মনে আছে 'ঝঞ্ঝা-মল্লার।'  অর্থাৎ মল্লার ঘরের কোনো একটি রাগ। ঝঞ্ঝা-মল্লার নামটা ঠিক শুনেছিলাম কি না, এখন সন্দেহ পোষণ করি। কারণ, এ নাম আর কোনো জায়গায় শুনতে পাইনি...।' কবি নজরুল ইসলাম ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত নজরুল-সংগীত সংগ্রহ [জুন ২০১৮, পৃষ্ঠা ৪]-এ গানটির শিরোনামে রাগ 'চর্জ্যু কি মল্লার' উল্লেখ আছে। গানটির সুরের সাথে 'চর্জ্যু কি মল্লার' রাগের কোনো মিল নেই।

জগ্মময় মিত্রের উল্লেখিত গ্রন্থ থেকে জানা যায় গানটি রেকর্ড করা হয়েছিল '১৮-৫-৩৯' তারিখে। গানটি রেকর্ড হয়েছিল আগে, কিন্তু রেকর্ডে প্রকাশিত হয়েছিল পরে। কারণ, রেকর্ডের এই গানের জুড়ি গান ছিল- অজয় ভট্টাচার্যের লেখা 'সন্ধ্যা যখন নামে গোপন পায়'। একই রেকর্ডে দুই রচয়িতার গান প্রকাশিত হলে- স্বত্বাধিকারের অর্থ ভাগাভাগি হতো। এই অসুবিধা দূর করার জন্য রেকর্ডে কোম্পানি নজরুলের রচিত অপর একটি গান 'গুনগুনিয়ে ভ্রমর এলো' রেকর্ড করে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে। আর উভয় গান মিলে রেকর্ডি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে।

  • গ্রন্থ:  
    • নজরুল গীতি, অখণ্ড
      • প্রথম সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ৬ আশ্বিন ১৩৮৫। ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮]
      • দ্বিতীয় সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ১ শ্রাবণ ১৩৮৮। ১৭ জুলাই ১৯৮১]
      • তৃতীয় সংস্করণ [ব্রহ্মমোহন ঠাকুর সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ৮ মাঘ ১৪১০। ২৩ জানুয়ারি ২০০৪] কাব্য-গীতি। ৭০৬ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ১৮২]
      • পরিবর্ধিত সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। বৈশাখ শ্রাবণ ১৪১৩। এপ্রিল-মে ২০০৬] ৭০২ সংখ্যাক গান। পৃষ্ঠা: ১৩২।
  • নজরুল গীতিমালা ৩য় খণ্ড। প্রথম প্রকাশ [বাঙলা একাডেমী, ঢাকা। ভাদ্র ১৩৭৭। সেপ্টেম্বর ১৯৭০। ২০ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ৫৭-৫৯]
    • নজরুল-সংগীত সংগ্রহ [রশিদুন্‌ নবী সম্পাদিত। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। তৃতীয় সংস্করণ দ্বিতীয় মুদ্রণ, আষাঢ় ১৪২৫। জুন ২০১৮। গান ১০। পৃষ্ঠা ৪]
    • নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি (প্রথম খণ্ড)। স্বরলিপিকার: সুধীন দাশ। প্রথম প্রকাশ, তৃতীয় মুদ্রণ [কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। অগ্রহায়ণ ১৪০২। নভেম্বর ১৯৯৫। ১০ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ৬৩-৬৬]  [নমুনা]
    • বুলবুল─দ্বিতীয় খণ্ড (গান, ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৯ বঙ্গাব্দ)।
    • নজরুল-রচনাবলী─ষষ্ঠ খণ্ড [নজরুল জন্মশতবর্ষ সংস্করণ। বাংলা একাডেমী, ১২ই ভাদ্র ১৪১৪। ২৭শে আগস্ট, ২০০৭। ৩৮ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ২৭২]
  • রেকর্ড:
    • এইচএমভি। [এপ্রিল ১৯৪০ মাসে (চৈত্র ১৩৪৬-বৈশাখ ১৩৪৭)। এন ১৭৪৪৮। শিল্পী জগন্ময় মিত্র। রাগ - চর্জ্যু কি মল্লার। (বন্দিশ - আজু ঝরেলা)। তাল - কার্ফা (রেকর্ডে)।][শ্রবণ নমুনা]
    • এইচএমভি [জুন ১৯৪৩ (আষাঢ়-শ্রাবণ ১৩৫০)। রেকর্ড নং- এন.২৭৩৭৮। শিল্পী। ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র (ফেলু বাবু) ] [শ্রবণ নমুনা] 
  • স্বরলিপিকার ও স্বরলিপি:  সুধীন দাশ।  নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি (প্রথম খণ্ড)।  প্রথম প্রকাশ, তৃতীয় মুদ্রণ [কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। অগ্রহায়ণ ১৪০২। নভেম্বর ১৯৯৫। দশম গান] [নমুনা]
     
  • পর্যায়:
    • বিষয়াঙ্গ: প্রেম
    • সুরাঙ্গ: রাগ ভাঙা গান।  মূল বন্দিশ - আজু ঝরেলা। রাগের নাম জানা যায় নি।
    • তাল: কাহারবা
    • গ্রহস্বর: মা।

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।