কারার ঐ লৌহ-কপাট (karar oi louho-kopat)
সিনেমা: চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন।
তাল: দ্রুত-দাদ্রা
কারার ঐ লৌহ-কপাট
ভেঙ্গে ফেল্ কর্ রে লোপাট রক্ত-জমাট
শিকল-পূজার পাষাণ-বেদী!
ওরে ও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ ! ধ্বংস-নিশান
উঠুক প্রাচী-র প্রাচীর ভেদি'॥
গাজনের বাজনা বাজা !
কে মালিক? কে সে রাজা? কে দেয় সাজা
মুক্ত-স্বাধীন সত্য কে রে?
হা হা হা পায় যে হাসি, ভগবান প'রবে ফাঁসি? সর্বনাশী —
শিখায় এ হীন্ তথ্য কে রে?
ওরে ও পাগ্লা ভোলা, দেরে দে প্রলয়-দোলা গারদগুলা
জোরসে ধ'রে হ্যাঁচকা টানে।
মার্ হাঁক হায়দরী হাঁক্ কাঁধে নে দুন্দুভি ঢাক ডাক ওরে ডাক
মৃত্যুকে ডাক জীবন-পানে॥
নাচে ঐ কাল-বোশেখী, কাটাবি কাল ব'সে কি?
দে রে দেখি ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি'।
লাথি মার, ভাঙ্রে তালা ! যত সব বন্দী-শালায় —
আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা, ফেল্ উপাড়ি॥
- রচনাকাল, স্থান ও প্রেক্ষাপট: ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ-এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় 'বাঙ্গলার কথা' নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। এই সময় গান্ধীজীর নেতৃত্বে সত্যাগ্রহ আন্দোলন চলছিল। তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী এই আন্দোলন দমনের জন্য ব্যাপকভাবে বহু তরুণকে গ্রেফতার করে। এই সময় স্বদেশী ভাবপুষ্ট লেখা প্রকাশের জন্য, ব্রিটিশ-ভারতের পুলিশ ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই ডিসেম্বর চিত্তরঞ্জন দাশ-কে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে দেয়। এই সময় পত্রিকার হাল ধরেন তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবী। বাসন্তী দেবী তাঁর পত্রিকায় একটি কবিতা পাঠানোর জন্য সুকুমাররঞ্জন দাশকে নজরুল ইসলামের কাছে পাঠান। সেই সূত্রে নজরুল ইসলাম এই কবিতাটি রচনা করে সুকুমাররঞ্জন দাশ-এর হাতে অর্পণ করেন। তিনি (চিত্তরঞ্জন দাশ) এই গানটি হুগলী জেলে স্বদেশী আন্দোলনের সাথে জড়িত বন্দী এবং অন্যান্য বন্দীদের সাথে গাইতেন বলে জানা যায়। অবশ্য এই কবিতার 'যত সব বন্দী-শালায়' অংশটি 'বন্দী-শালা' পড়ে বন্দীরা হট্টগোল শুরু করে। পরে অবশ্য তাঁরা তাঁদের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। উল্লেখ্য, তৎকালীন ভারত সরকার গানটিকে নিষিদ্ধ করেছিল। উল্লেখ্য, গানটি 'ভাঙার গান' শিরোনামে 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকার '২০ জানুয়ারি ১৯২২' সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।
'ভাঙার গান' শীর্ষক এই গানটি সম্পর্কে কমরেড মুজফ্ফর আহমদ 'কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা'-তে লিখেছেন—
"আমার সামনেই দাশ-পরিবারের শ্রী সুকুমাররঞ্জন দাশ 'বাঙ্গলার কথা'র জন্য একটি কবিতা চাইতে এসেছিলেন। শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী তাঁকে কবিতার জন্যে পাঠিয়েছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তখন জেলে। ... অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নজরুল তখনই কবিতা লেখা শুরু ক'রে দিল। সুকুমাররঞ্জন আর আমি আস্তে আস্তে কথা বলতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে নজরুল আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে তার সেই মুহূর্তে রচিত কবিতাটি আমাদের পড়ে শোনাতে লাগল। ... নজরুল 'ভাঙার-গান' লিখেছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের কোনো এক তারিখে। 'ভাঙার গান' বাঙ্গলার কথা'য় ছাপা হয়েছিল।" মুজাফ্ফর আহমদ-এর বিবৃতি অনুসারে বলা যায়, যায় গানটি রচিত হয়েছিল ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর (অগ্রহায়ণ-পৌষ ১৩২৮) মাসে। এই সময় নজরুল ইসলামের বয়স ছিল ২২ বৎসর ৬ মাস।
- ভাবসন্ধান: এ গানটি সম্পর্কে এক কথায় বলা যায়- তৎকালীন ব্রিটিশ-বিরোধী বিপ্লবীদের জন্য একটি উদ্দীপনামূলক গান। এই গানে- কারাগারের লৌহকপাট এবং রক্ত-জমাটকরা ভয়ঙ্কর আসন ভেঙে ফেলার জন্য, ঈশানরূপী (মহাদেবের অষ্ট মূর্তির একটি) তরুণদের আহবান করা হয়েছে। কবি কামনা করছেন, বিদ্রোহী তরুণদের হাতে ধ্বনিত হোক মহাদেবের প্রলয়ঙ্করী শিঙা, পূর্বদেকের (প্রাচী-র) আলোক-প্রতিবন্ধী প্রাচীর ভেদ করে উত্তোলিত হোক ধ্বংসের পতাকা। এই ধ্বংসের ভিতর দিয়ে জেগে উঠবে স্বাধীনতার নতুন পতাকা, স্বাধীনতার নতুন সূর্য আলো ছড়াবে জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
কবি পাগলা ভোলারূপী (মহাদেব) তরুণদের ডেকে বলছেন, প্রচণ্ড ধ্বংসের দোলা সব কারাগারকে আন্দোলিত করুক আর হ্যাঁচকা টানে সেগুলোকে ধ্বংস করুক। হায়দরী হাঁক (যুদ্ধের সময় হযরত আলী যে হাঁক দিতেন) হেঁকে আর যুদ্ধের দুন্দুভি (বড় ঢাক বিশেষ) বাজিয়ে মৃত্যুর আলয়কে ধ্বংস করে, সে মৃত্যু যেন মুক্তজীবনের আকাঙ্ক্ষাকে উজ্জীবিত করুক। কবি তরুণদের ডেকে বলছেন, বিধ্বংসী কালবৈশাখীর মতো আন্দোলন সমাসন্ন, এখন বসে বসে কাল কাটানোর অবসর নেই। এখন অটল কারাগারের ভিত্তিকে নড়িয়ে দিতে হবে। কবি কামনা করছেন, যত কারাগার আছে, পদাঘাতে তার সবগুলোর তালা খুলে যাক, আগুনের লেলিহান শিখায় ধ্বংস হয়ে যাক সকল বন্দীকারাগার, সমূলে উৎপাটিত হোক পরাধীনতার জগদ্দল পাথর।
এই গানের ভিতর দিয়ে নজরুল তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের আহ্বান করেছিলেন। তিনি বিপ্লবীদের মনে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন পরাধীনতার বন্দী দশা থেকে মুক্ত হওয়ার বার্তা।
- গ্রন্থ: ভাঙার গান প্রথম সংস্করণ। শ্রাবণ ১৩৩১ বঙ্গাব্দ (আগষ্ট ১৯২৪)। শিরোনাম 'ভাঙার গান'।]
- পত্রিকা: বাঙলার কথা [২০ জানুয়ারি, ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ (শুক্রবার, ৭ মাঘ ১৩২৮)। শিরোনাম: ভাঙার গান]
- রেকর্ড :
- কলাম্বিয়া [জুন ১৯৪৯ (জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় ১৩৫৬)] জি.ই. ৭৫০৬। শিল্পী: গিরীন চক্রবর্তী।
- এইচএমভি [জানুয়ারি ১৯৫০ (পৌষ-মাঘ ১৩৫৬)] এন. ৩১১৫২। শিল্পী: গিরীন চক্রবর্তী। [শ্রবন নমুনা]
- চলচ্চিত্র: চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন।১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ নভেম্বর (রবিবার ১১ অগ্রহায়ণ ১৩৫৬)। [প্রচার পুস্তিকা]
- স্বরলিপিকার ও স্বরলিপি: রশিদুন্ নবী। নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি (বিংশ খণ্ড)। [কবি নজরুল ইন্সটিটিউট] পঞ্চম গান [নমুনা]
- সুরকার: কাজী নজরুল ইসলাম
- পর্যায়:
- বিষয়াঙ্গ: স্বদেশ
- সুরাঙ্গ: সামরিক মার্চ
- তাল: দ্রুত দাদরা
- গ্রহস্বর: সা