সই ভাল ক'রে বিনোদ-বেণী বাঁধিয়া দে (soi bhalo kore binod beni)
সই ভাল ক'রে বিনোদ-বেণী বাঁধিয়া দে
মোর বঁধু যেন বাঁধা থাকে বিননী-ফাঁদে॥
সই বাঁধিতে সে বাঁধন-হারা বনের হরিণ
সই জড়ায়ে দে জরীণ ফিতা মোহন ছাঁদে॥
সই চপল পুরুষ সে তাই কুরুশ কাটায়
রাখিব খোঁপারি সাথে বিঁধিয়া লো তায়।
তাহে রেশমি জাল বিছায়ে দে ধরিতে চাঁদে॥
প্রথম প্রণয়-রাগের মত আলতা রঙে
রাঙায়ে দে চরণ মোর এমনি ঢঙে।
সই পায়ে ধ'রে সে যেন লো আমারে সাধে॥
- ভাবসন্ধান: এটি প্রেম পর্যায়ের একটি গান। এই গানে ফুটে উঠেছে- কাঙ্ক্ষিত পুরুষকে প্রেমিক হিসেবে পাওয়ার জন্য প্রণয়াকাঙ্ক্ষা। এই গানের প্রেমাকাঙ্ক্ষী নায়িকা ছল-কৌশলে তাঁর কাঙ্ক্ষিত পুরুষকে সাজসজ্জার মোহজাল বিছিয়ে বাঁধতে চান। এই সাজ-সজ্জার জন্য তিনি তাঁর সখীকে ডেকে বলছেন, তিনি যেন এমন এক আনন্দপ্রদায়ী মোহনীয় বেণী রচনা করে দেন, সে বেণীর বিনুনির ফাঁদে কাঙ্ক্ষিত পুরুষ ধরা পড়ে।
অন্তরাতে নায়িকা তাঁর বেণী রচনার উদ্দেশ্যকে আরও বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করে সখিকে বলছেন- তাঁর কাঙ্ক্ষিত পুরুষ অত্যন্ত চপল, তাঁকে প্রেমকণ্টকে গেঁথে রাখতে চান। শিথিল খোঁপাকে দৃঢ়তর করে রাখার জন্য, যে কুরুশ কাঁটা সখী ব্যবহার করবেন, সে শুধু খোঁপা বাঁধবার জন্য নয়। তার চেয়ে বেশি এই বেণীর কাঁটা যেন হয়ে ওঠে কাঙ্ক্ষিত পুরুষকে ধরে রাখার প্রেমকণ্টক।
সঞ্চারীতে নায়িকা সখীকে একই উদ্দেশ্যে বলছেন, খোঁপা ঘিরে তিনি যেন জরির ফিতা এমন মোহনীয় করে জড়িয়ে দেন, যার আবেশে বনের হরিণের মতো বাধনহারা তাঁর কাঙ্ক্ষিত পুরুষ বাঁধা পড়ে যায় প্রেমের ফাঁদে।
আভোগে নায়িকা সখিকে আলতা দিয়ে পা রাঙিয়ে দেওয়ার কথা বলছেন। এখানে নায়িকা শুধুই কাঙ্ক্ষিত পুরুষের কাছে দর্শনীয় করবার জন্য আলতার ব্যবহার করতে চান নি। তিনি চান, আলতার মোহনীয় কাঙ্ক্ষিত পুরুষে প্রেমে নিবেদিত অনুগত পুরুষ হিসেবে। তাই সখীকে বলেছে এই আলতার রঙ যেন হয় প্রথম প্রণয়ের আবেশিত প্রণয়-রাগের মতো। যা দেখে তাঁর কাঙ্ক্ষিত পুরুষ তাঁরই প্রণয়রাগে আবেশিত হয়ে তাঁর প্রণয়পাশে ধরা দেওয়ার জন্য উদ্বেলিত হয়ে উঠবে। কাঙ্ক্ষিত পুরুষ যেন, আত্মহারা হয়ে, প্রেমকামনায় কাঙালের মতো তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়ে।
গানটির ভিতরে রয়েছে চটুল রূপ। তাই গানটির সুর এবং ছন্দ, সে চটুলতাকে অবলম্বন করে গ্রথিত হয়েছে। গজল অঙ্গের এই গানের সুরের চলন সিন্ধু-ভৈরবীর শৃঙ্গার রসরূপ প্রকটীত।
- রচনাকাল ও স্থান: এই গানটির প্রাথমিক রূপ পাওয়া যায় নজরুল ইসলামের রচিত লেটো গান। লেটো গানটি হলো—
ও সই, বেঁধেছে বিনুনী মোর নতুন ছাঁদে।
যেন বঁধু বাঁধা পড়ে মোর বিনুনী ফাঁদে॥
অঙ্গেতে পরায় দে নীলাম্বরী,
এনে দে আল্তা লো পায় পরি,
যেন ও মন বাঁধ্তে পারি, মনেরি বাঁধে॥
এই সময়ে নজরুল ইসলামের বয়স ছিল ১১-১৩ বৎসর।
এরপর কবি এই গানটি পরিবর্তন করে নতুন রূপ দেন তাঁর ৩৩ বৎসর বয়সে। ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে প্রকাশিত সুর-সাকী গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৩৩ বৎসর ১ মাস।
- গ্রন্থ:
- সুর-সাকী
- প্রথম সংস্করণ [আষাঢ় ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ। জুলাই ১৯৩২]
- নজরুল রচনাবলী, জন্মশতবর্ষ সংস্করণ, চতুর্থ খণ্ড। বাংলা একাডেমী, ঢাকা। [জ্যৈষ্ঠ ১৪১৮, মে ২০১১। সুর-সাকী। ২২। সিন্ধু-কার্ফা। পৃষ্ঠা: ২৩৫]
- সুর-সাকী
- রেকর্ড: টুইন। [ডিসেম্বর ১৯৩২ (অগ্রহায়ণ-পৌষ ১৩৩৯)]। এফটি ২৩১৬ শিল্পী: মিস্ বীণাপাণি] [শ্রবণ নমুনা]
- স্বরলিপিকার ও স্বরলিপি:
- নজরুল রচনাবলী, জন্মশতবর্ষ সংস্করণ, চতুর্থ খণ্ড। বাংলা একাডেমী, ঢাকা। [জ্যৈষ্ঠ ১৪১৮, মে ২০১১। সুর-সাকী। ২২। সিন্ধু-কার্ফা। পৃষ্ঠা: ২৩৫]
- সুধীন দাশ। [নজরুল-সঙ্গীত স্বরলিপি, ত্রয়োদশ খণ্ড। প্রথম সংস্করণ। নজরুল ইন্সটিটিউট । জ্যৈষ্ঠ ১৪০১/মে ১৯৯৪। ২৪ সংখ্যক গান] [নমুনা]
- পর্যায়:
- বিষয়াঙ্গ: প্রেম
- সুরাঙ্গ: স্বকীয় বৈশিষ্ট্য
- রাগ: সিন্ধু-ভৈরবী
- তাল: কাহারবা
- গ্রহস্বর: পা